উন্নত জাতের আম

 উন্নত জাতের আমের নাম অনেকেই জানতে চায়। আম আমাদের সকলের কাছেই পরিচিত একটি ফলের নাম। 


বৈশাখ মাসের শুরুতেই কাঁচা আমের স্বাদ দিয়ে শুরু তারপরে জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত পাকা আমের স্বাদ দিয়ে শেষ । আম একটি মজাদার এবং রসালো ফল তাই আমরা প্রতিবছর আমের মৌসুমে প্রচুর আম খেয়ে থাকি।


 বাংলাদেশে সাধারণত আম পাকে জৈষ্ঠ আষাঢ় মাসে। এই দুই মাসে বাংলাদেশের বাজারে প্রচুর পরিমাণে আমের সরবরাহ থাকে। 


বাংলাদেশের প্রায় প্রত্যেক অঞ্চলের মানুষ জৈষ্ঠ আষাঢ় মাসে প্রচুর পরিমাণে আম খেয়ে থাকে। বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রজাতির আম চাষ হয়ে থাকে।


আম খেতে কোনোটা মিষ্টি, কোনোটা টক। দেখতে কোনোটা লম্বা, কোনোটা গোল। নানা বৈচিত্র্যের জন্যই আমের এত চেহারা ও স্বাদ। এ দেশে আমের বৈচিত্র্যের শেষ নেই। বীজ থেকে উৎপন্ন গাছকে গুটির গাছ বলা হয়।


 এসব গাছের আম গুটি আম নামে পরিচিত। আম বাংলাদেশের প্রধান চাষযোগ্য অর্থকরী ফলগুলোর মধ্যে অন্যতম। বৈচিত্রপূর্ণ ব্যবহার, পুষ্টিমান এবং স্বাদেগন্ধে ফলটি অতুলনীয়। যার কারণে আমকে ফলের রাজা বলা হয়।



উন্নত জাতের আম কি?

বিশেষ পদ্ধতি বা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমের অনুন্নত জাতকে উন্নত জাতে পরিনত করাই হচ্ছে আমের  উন্নত জাত প্রকিয়া। 


বেশ কয়েকটি পদ্ধতিতে কম উৎপাদনকারী বা সুস্বাদু আম জাতকে উন্নত বা বেশি উৎপাদনশীল বা সুস্বাদু জাতে পরিনত করা যায়। যেমন টপ ওয়ারকিং এর মাধ্যমে অনুন্নত জাতকে উন্নত জাতে পরিবর্তন করা যায়। 


এই পদ্ধতিতে প্রথমে অনুন্নত জাতের গাছটির উপরের অংশ কর্তন করা হয়। ডাল কর্তনের ৩০ থেকে ৪৫ দিন পর নতুন শাখা বের হয়। কর্তিত অংশ হতে অসংখ্য নতুন কুশি বের হয়। সুস্থ সবল ও রোগমুক্ত শাখাগুলো রেখে বাকিগুলো ভেঙে ফেলতে হবে। ছাঁটাইকৃত ডালে যে কুশি বের হবে সেগুলো মে-জুলাই মাস পর্যন্ত কলম করা যাবে।


 ক্লেফ্ট এবং ভিনিয়ার এই দুই পদ্ধতিতে কলম করা যায়। কলম করার পর মূল গাছের শাখা-প্রশাখা বের হলে তা ভেঙে ফেলতে হবে। নতুন জাতে পরিবর্তিত গাছে তৃতীয় বছর হতে আম উৎপাদন শুরু হয় এবং চতুর্থ বছর হতে ভাল ফলন দিতে শুরু করে।


বাংলাদেশে ১৯৯৩ সাল থেকে নতুন জাত উদ্ভাবনের উদ্দেশ্যে ক্রসিং বা সংকরায়ণের কাজ শুরু করা হয়েছে। এভাবে বাংলাদেশে অসংখ্য নতুন ও উন্নত জাতের আমের চাষ হচ্ছে।


উন্নত জাতের আমের নাম

আমের চেহারা, রং, রূপ, ঘ্রাণ, স্বাদ একে অন্যের থেকে আলাদা। গোলাপখাস, কাকাতুয়া, দাদভোগ, চম্পা, সূর্যপুরি, ক্ষীরভোগ, মোহনভোগ, ফজলি, চিনি ফজলি, বোম্বাই, কাঁচামিঠা, কলামোচা, লক্ষ্মণভোগ, আম্রপালি, হিমসাগর ইত্যাদি জাতের আম এখনো দেখা যায়।


 উন্নত জাতের আমের চাষ বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি দেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতেও অবদান রাখে। বাংলাদেশে চাষ হওয়া কিছু উন্নত জাতের আমের নাম ও সংক্ষিপ্ত বিবরন নিম্নে দেওয়া হলোঃ

১। আম্রপালি


আম্রপালি আম একটি হাইব্রিড জাতের আম। এটি আকারে বড়, ত্বক হলুদ এবং এর মাংস রসালো ও অত্যন্ত মিষ্টি। রূপালী আম বা আম্রপালি নিচের দিকে খানিকটা সুঁচালো বা চোখা এবং উপরে একটু গোলাকৃতির হয়। এই আম মিষ্টি বেশি ও স্বাদে অতুলনীয়।

২। ফজলি


ফজলি আম বাংলাদেশের অন্যতম একটি জনপ্রিয় আম। এটি মিষ্টি স্বাদের জন্য বিখ্যাত। আমটি দীর্ঘ এবং একটু চ্যাপ্টা। পাকা আমের খোসা কিছুটা হলুদ হয়ে ওঠে। শাঁস হলুদ, আঁশবিহীন, রসালো, সুগন্ধযুক্ত, সুস্বাদু ও মিষ্টি। খোসা পাতলা হয়। আঁটি লম্বা, চ্যাপ্টা ও পাতলা হয়। এই আমে শর্করার পরিমাণ ১৭.৫ শতাংশ।


 আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বা মোটামুটি জুলাই মাসের শুরু থেকে ফজলি আম পাকা শুরু করে। বাহারি আম ফজলি খেতে অত্যন্ত মিষ্টি। এটি টক গন্ধযুক্ত বড় আকারের একটি মিষ্টি স্বাদের আম | এটি কালচে সবুজ রঙের আম।

৩। ল্যাংড়া




ল্যাংড়া আম বাংলাদেশের আরেকটি জনপ্রিয় আমের নাম। এটি রসালো এবং মিষ্টি স্বাদের জন্য সবার কাছে পরিচিত। ল্যাংড়া আম দেখতে কিছুটা গোলাকার ও মসৃণ। এর নাক নিচের দিকে থাকে। এর খোসা খুবই পাতলা। এই আম দেখতে অনেকটা আয়তাকার গোল হয়ে থাকে। এই আমের খোসা হালকা সবুজ রঙের হয়ে থাকে।


 এই আম পাকলে সম্পূর্ণ হলুদ রঙের হয়না। খোসা খুবই পাতলা হয়ে থাকে এবং শাঁস হালকা হলুদ রঙের হয়। এই জাতের আম ঠিক করে না পাকলে খেলে মুখ চুলকায়। ল্যাংড়া আম সুঘ্রানের জন্য খুবই বিখ্যাত।

৪। গোপালভোগ


গোপালভোগ আম বাংলাদেশের একটি পুরাতন জাতের আম। এটি মিষ্টি এবং সুগন্ধি স্বাদের জন্য সকলের কাছে বেশি পরিচিত। গোপালভোগের গায়ে সাধারণত হলুদ ছোপ ছোপ দাগ থাকে। এটির নিচের দিকে একটু সরু এবং পাকার পর হলুদ হয়ে যায়। মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে বাজারে গোপালভোগ আম পাওয়া যায়।

৫। খিরসাপাত

খিরসাপাত আম বাংলাদেশের একটি সুস্বাদু জাতের আম। এটি মিষ্টি এবং রসালো স্বাদের জন্য বিখ্যাত। খুবই মিষ্টি ক্ষীরসাপাতি আমকে অনেকে হিমসাগর বলে বিক্রি করে থাকে। এই আম আকারে একটু বড় হয়। আমের গায়ে হালকা দাগ থাকে। ক্ষীরসাপাতি আম বাজারে পাওয়া যায় মে মাসের শেষে অথবা জুনের প্রথম দিকে।


৬। আলফানসো

ভারতে উৎপন্ন হওয়া সবচেয়ে উন্নত জাতের আম হল আলফানসো। আলফোনসো আমকে বিশ্বের সেরা আম হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। আলফানসো আম বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় আম। এটি বাংলাদেশেও খুব জনপ্রিয়। ফলটির নামকরণ করা হয়েছে আফনসো ডি আলবুকার্ক একজন পর্তুগিজ জেনারেল এর নামানুসারে।

৭। হিমসাগর


হিমসাগর আম খুবই জনপ্রিয় একটি আম।এই জাতের আম পাকলে হলুদ সবুজ রঙের হয়ে যায়। এই আমগুলি সাধারণত মাঝারি আকারের হয়ে থাকে। এগুলি খুব মিষ্টি, খুবই সুস্বাদু ও সুঘ্রাণযুক্ত হয়ে থাকে। এই আমের জাত আমকে সবচেয়ে সেরা জাত হিসাবে বিবেচনা করা হয়। উৎকৃষ্ট স্বাদের সুগন্ধযুক্ত জাতের আমের মধ্যে হিমসাগরের অবস্থান প্রায় সবার উপরে। হিমসাগর আম জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে পাঁকতে শুরু করে এবং পুরো জুন মাস বাজারে পাওয়া যায়। এ আমের ঠোঁট নেই, গড়ন বুকের দিকটা গোলাকার এবং অবতল থেকে সামান্য লম্বাটে আকার নিয়ে শীর্ষদেশ গোলাকৃতির হয়ে থাকে। পরিপক্ক হিমসাগর আমের রং হালকা সবুজ। পাকার পরেও সবুজ থেকে যায়। ত্বক মসৃণ, খোসা পাতলা হয়।

৮। হাড়িভাঙ্গা


রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার বিখ্যাত ও সুস্বাদু আমের নাম হচ্ছে হাড়িভাঙ্গা। এ আমের উপরিভাগ তুলনামূলক বেশি মোটা ও চওড়া এবং নিচের অংশ অপেক্ষকৃত চিকন হয়ে থাকে। আকারে বড় হওয়ার কারেণ প্রায় ৩টি আমে ১কেজি হয়ে যায়। এ আম মাংসালো, শ্বাস গোলাকার ও একটু লম্বা। চামড়া কুঁচকে যায় কিন্তু পঁচে না।

৯। জাফরান

জাফরান জাতের আম আকারে লম্বা। এই ধরনের ফলের ভালো সঞ্চয় ক্ষমতা রয়েছে। এটি জাফরানের মতো সুগন্ধির জন্য জনপ্রিয় আম। এই জাতের আমের মাংসে কোন আঁশ নেই। এটি সাধারণত মিল্কশেক, মিষ্টি ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এই জাতের আম হালকা সবুজ এবং হলুদ বর্ণের হয়ে থাকে।

১০। মালদা



এই আমটি ভারতের উত্তর -পূর্ব রাজ্যে শেহরোলি নামেও পরিচিত। এর মাধুর্যের কারণে এটি শুধু দেশে নয় বিদেশেও খুব গ্রহনযোগ্যতা পেয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকা, সুইডেন, দুবাইয়ের মতো দেশে এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এটি আগাম পরিপক্ক জাতগুলির মধ্যে একটি।

১১। সূর্যডিম

বাংলায় এই আমটি পরিচিতি পেয়েছে “সূর্যডিম” নামে। আমটি বাংলাদেশের কোন জাত নয়। এটি জাপানি প্রজাতির তবে এখন এটি বাংলাদেশে চাষ হচ্ছে। জাপানি ভাষায় আমটিকে বলা হয় ‘মিয়াজাকি’। বিশ্ববাজারে এটি ‘রেড ম্যাঙ্গো’ বা ‘এগ অব দ্য সান’ নামেও পরিচিত। এই আমের গড়ন সাধারণ আমের চাইতে বড় ও লম্বা, স্বাদে মিষ্টি এবং আমের বাইরের আবরণ দেখতে গাঢ় লাল অথবা লাল-বেগুনির মিশ্রণে একটি রঙের। একেকটি আমের ওজন ৩৫০ থেকে ৪৫০ গ্রামের মতো। মিষ্টি স্বাদ, ভিন্ন রঙ এবং চাষপদ্ধতির কারণে আমটির দাম একটু বেশি।

১২। গৌরমতি


স্বাদে ও গন্ধে অতুলনীয় । নাবি জাতের আমের মধ্যে গৌরমতি আমের স্বাদ, মিষ্টতা এবং ফলন বেশি হওয়ায় কৃষকরা এখন এই আম চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। এই আমটি আকারে ডিম্বাকৃতির, প্রতিটি ২৫০ থেকে ৬০০ গ্রাম পর্যন্ত ওজন হতে পারে। পরিপক্ব ফলের রং হালকা হলুদ।এই আমটি ল্যাংড়া বা খিরসাপাটা অর্থাৎ হিমসাগরের চেয়ে ১৮/২০% বেশি মিষ্টি। আম পাকা হয়ে গেলে হলুদ ও সিঁদুর মিশ্রণে দারুণ লাগে। গৌরমাতি আমেতে মিষ্টি পাশাপাশি উচ্চ স্তরের খনিজ রয়েছে।এই আমের খোসা এবং আটি দুটোই পাতলা এবং আটি ছোট তাই এই আমের ভোজ্য অংশ বেশি হয়।

বহুল জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন ও উত্তর সমূহ

উন্নত জাতের আমের নাম এই বিষয়ে আপনাদের মনে বেশ কিছু পশ্ন থাকতে পারে। তবে চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই সমস্ত সকল প্রশ্ন ও তার উত্তর।

বাংলাদেশে কত ধরনের আম আছে?

বাংলাকেই আমের আদিভূমি বলে মনে করেন অনেক ঐতিহাসিকগন। এ দেশে ৮০০ থেকে ১০০০ প্রকারের জাতের আম রয়েছে।

উন্নত জাতের আমের কয়েকটি নাম জানতে চাই।

উন্নত জাতের আমের প্রায় কয়েকশ জাত রয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি হলোঃ আম্রপালি, হিমসাগর, সূর্যডিম, গৌরমতি, মালদা, জাফরা, মল্লিকা, সুবর্নরেখা, কালীভোগ, ফজলি, ল্যাংড়া, গোপালভোগ, আলফানসো, গোপাল খাস, খিরসাপাত, অরুনা, কাঁচামিঠা, সূর্যপূরী, ত্রিফলা, হাড়িভাঙ্গা, আদাইরা ও আম রূপালি ইত্যাদি।

উপসংহার

ভারতীয় উপমহাদেশে আমকে ফলের রাজা বলা হয়। ভাল বা উন্নতজাতের আমের চাহিদা দেশব্যাপী। বর্তমানে বাংলাদেশের সকল জেলাতেই আমের চাষাবাদ হচ্ছে। অন্যান্য জেলাগুলোতে বেশিরভাগ আম গাছ বীজ থেকে হওয়া বা গুটি প্রকৃতির। ফলে বীজের গাছ হতে ভাল জাতের আম পাওয়া সম্ভব নয়, যার জন্য প্রতি বছর বিভিন্ন বয়সের আম গাছ চাষিরা কেটে ফেলেন। কিন্তু অতি সহজেই টপ ওয়ারকিং এর মাধ্যমে অনুন্নত জাতকে উন্নত জাতে পরিবর্তন করা যায়। বেশি ফলন, রোগ প্রতিরোধী, সুস্বাদু আমের জাতের প্রতি ঝুঁকে যাচ্ছে চাষীরা। তাই তারা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন নার্সারিতে খুঁজে বেড়াচ্ছে উন্নত জাতের আমের নাম। এছাড়াও আপনার জ্ঞানকে প্রসারিত করতে আম সম্পর্কে ১০ টি বাক্য সম্পর্কে পড়তে পারেন।

“উন্নত জাতের আমের নাম” এই বিষয়ে আপনার যদি কিছু জানার থাকে তবে আপনি এই পোস্টের নিচে মন্তব্য করতে পারেন। এছাড়াও এই পোস্ট-টি তথ্যবহুল মনে হলে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে পারেন। ধন্যবাদ।



এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url